
মো. জুবায়ের ইসলাম, তিতুমীর কলেজ প্রতিনিধি:
মহাখালী কড়াইল বসতি এলাকা। যেখানে ঘরবাড়ি ছাড়া মানুষদের বসবাস। তাদের নেই তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, চারদিকে মাদকের ছড়াছড়ি। এমন স্থানে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে স্থানীয় ব্যক্তি, ডাক্তার শহিদুল ইসলাম নিজ উদ্যোগে ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন "কড়াইল কিন্ডার গার্টেন এন্ড হাই স্কুল"। এই স্কুলের সহযোগী ইংরেজি শিক্ষক সুমন ইসলাম। শিক্ষক দিবসে সম-সাময়িক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তার কথা গুলো লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন মো. জুবায়ের ইসলাম-
শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে পথচলা শুরু কীভাবে?
সুমন ইসলাম: প্রতিটি মানুষ ই ব্যাক্তি অবস্থান থেকে একজন শিক্ষক এবং শিক্ষা দানের স্পৃহা মানুষের মাঝে বিদ্যমান। সেই স্পৃহা থেকেই এলাকার আসে পাশে ঘরের কিছু ছেলে-মেয়েদের পড়াতাম। বিনামূল্যে পড়ানোর জন্য বাবা মা ও জোর করেই পাঠাতো। তবে শুরু টা হয়েছিল ৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ক্লাস সেভেনে পড়া অবস্থায়। তারপর সময়ের পরিক্রমায় তিতুমীর এ ভর্তির পর আমার বন্ধু কাইয়ুম এর সাথে পরিচয়। কথা আলোচনায় উঠে আসে "কড়াইল কিন্ডার গার্টেন এন্ড হাই স্কুল" এর আলোচনা। কাইয়ুম ছিল সেখানের সহকারী ইংরেজি শিক্ষক। তারপর তার মাধ্যমে সেই স্কুলে প্রবেশ। প্রথম দিন ভাইভা দিয়েই ডেমো ক্লাস নিলাম ৪ টা । নিজের মাঝে কিছু জড়তা ছিল তখনো। তবে ক্লাস শিক্ষার্থীদের সাথে কুশল বিনিময় করে তাদের ভালো ভাবে সকল বিষয় বুঝিয়ে দেই যে, মুলত পড়াশোনা কি এবং কিভাবে করতে হয়।
ছেলে হিসেবে শিক্ষকতা পেশা কতটুকু উপভোগ্য ও কতটা চ্যালেঞ্জিং?
সুমন ইসলাম: দায়িত্ববোধ সম্পূর্ণ প্রতিটি মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ এর মতো। যার চ্যালেঞ্জ শুরু হয় সূর্যের উকি দেয়ার সাথে সাথেই। তবে ঘুম ভাঙ্গার পূর্বে শিক্ষার্থীদের মূখ ভেসে ওঠা স্বপ্ন আর তার সাথে সেই সু-কন্ঠের এলার্ম "স্যার, আগামীকাল আসবেন তো" যা আমার দায়িত্ব কে অনায়াসে সহজ করে তুলে। তাদের উৎফুল্ল মুখের বাইরে উপভোগ যোগ্য সৌন্দর্য পৃথিবীতে বিরল।
জীবনের প্রথম ধাপ প্রাইমারি স্কুল। এই ধাপে কাজ করে ভয়। শিক্ষার্থীদের এই ভয় জয় করে স্কুলে পাঠানোর কৌশল কী?
সুমন ইসলাম: ভয় বলতে তেমন কিছু নেই, অভাব আনন্দের। শিশু মাত্রই আনন্দ প্রেমী । তাদের যে কোন বিষয়কে নাটকীয় ভঙ্গিতে এবং গল্প আকারে উপস্থাপন করলে সহজেই তারা সেটি রপ্ত করে নেয়। বাকি একটা বিষয় থাকে যে স্যাররা মারে। কিন্তু পড়ার বিষয় মজাদার হলে হাজার মারলেও সেটা আপনাকে বলবে না যে স্যার মারে।
শিক্ষার্থীদের এই প্রাথমিক ধাপ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
সুমন ইসলাম: প্রতিটি শিশুর জন্য শিশুকাল টা উপভোগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তার মানসিক ও মানবিক বিকাশের জন্য। ভালো, মন্দ, আনন্দ, উল্লাস, সত্য-মিথ্যা ও সৃষ্টির সকল কিছুর প্রাথমিক জ্ঞান তারা পায় প্রাথমিক স্তরে। এ স্তর না থাকলে তারা তো শিক্ষা কি সেটাই বুঝবে না, জীবন কি জানবে না। প্রাথমিক শিক্ষাই শিশুর শৈশবের প্রথম শিক্ষা, শিক্ষার্থীর জীবনের মূলভিত্তি।
শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের কীভাবে ক্লাসে সার্বিক পরিস্থিতি বজায় রাখেন?
সুমন ইসলাম: ধৈর্য এক অনন্য গুণ আর ধর্মের আলোচনা ধর্মের কথা নিরবতার মূল মন্ত্র। শিক্ষার্থীদের ক্ষমার শিক্ষা, হিংসা দূরের মূলমন্ত্র শিখাই। চরিত্র গঠনের মৌলিক চাবিকাঠি হলো হাদিস। বাকিটা তাদের মন বোঝার চেষ্টা করি সাথে তাদের আনন্দ,হাসি-খুশি, তাদের কলহ ইত্যাদি। তাদের সাথে আপনার ও বাচ্চা হতে হবে প্রয়োজনে। চিৎকার করে আকাশ ও ভাঙতে হবে তবেই তারা আপনার কথায় চলবে আপনাকে মানবে।
শিক্ষকতা পেশায় কোন প্রতিবন্ধকতা আছে কি না?
সুমন ইসলাম: হে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যেগুলো এমন যে লজ্জায় বলতে পারবেন না আর সেগুলো মানিয়ে নিতে আপনার মরুভূমির মত তৃষ্ণায় পড়তে হবে। আর কিছু ক্ষেত্রে এমন আছে যেখানে কিছু করলেও বিপদ আবার না করলেও বিপদ। তবু টিকে থাকতে হয়, টিকে থাকে প্রতিটা শিক্ষক।
যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা কিভাবে মোকাবিলা
করছেন?
সুমন ইসলাম: আমার স্কুলের পাশে বস্তির কিছু মাদকাসক্ত ছেলে ছিল এবং ক্লাসেও তাদের মত কিছু শিক্ষার্থী ছিল যারা প্রায়ই ক্লাসে মাদকাসক্ত হয়ে আসত। আর আসক্তির কারণে মাতলামি করে ক্লাস কার্যক্রম নষ্ট করত। স্থানীয় শিক্ষিত সমাজের সহায়তায় তাদের হাত থেকে মাদক দূর করা হয়। তারপর ব্যাক্তিগত উদ্যোগে তাদের পাশে ডাক্তার ও ধর্মীয় অনুশাসন ও বিধি নিষেধ সম্পর্কে পৃথক পৃথক ভাবে আলোচনা করি। আলহামদুলিল্লাহ এখন কেউ মাদক সেবন করে না।
যেসব শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় তাদের উদ্দেশ্য কী বলবেন?
সুমন ইসলাম: শিক্ষকতার মতো মহান, মানব প্রেমী মানুষের কল্যাণময় অন্য কোন কর্ম হয় না। সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা এবং সমাজের সমস্যা সমাধানে শিক্ষকদের তুলনা হয়না। পেশা হিসেবে শিক্ষকতার দ্বিতীয় কোন পেশা নেই। যদি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, মানুষের মাঝে মানবিক বোধ জাগ্রত করার ইচ্ছে থাকে তবে এই শিক্ষকতা পেশায় আশা উচিৎ সকলের।
কড়াইল কিন্ডার গার্টেন এন্ড হাই স্কুল সম্পর্কে আপনার মতবাদ কী?
সুমন ইসলাম: "কড়াইল কিন্ডার গার্টেন এন্ড হাই স্কুল" মূলত হতদরিদ্র পরিবারের আশার আলো স্বরুপ। শহরের দালানে যে সকল শিক্ষার্থীর জায়গা সংকুলান হয়না তাদের চোঁখে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতেই মূলত এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই যা দেশের ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে তাদের শিক্ষার্থী কে প্রেরণ করতে সক্ষম ও সফল সুনামের অধিকারী হয়েছে। ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দেশের প্রতিটি কোনায় আলো ছড়িয়ে দিবে এবং দেশ বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় সফলভাবে এগিয়ে যাবে।
শিক্ষক দিবসে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আপনার কী প্রত্যাশা?
সুমন ইসলাম: শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মমুখী নয়। আর কর্মমুখী যে ব্যবস্থা তা যথেষ্ট নিম্নমানের। শিক্ষার্থীদের উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষতা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও তৈরির কৌশল শিক্ষা দিতে হবে। হাতে-কলমে শিক্ষা ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাচীন পাঠ্য-পুস্তক থেকে বেরিয়ে কিভাবে একাধিক দক্ষতা অর্জন করা যায় তা দেখতে হবে। দিনে এক ঘন্টা হলেও ক্লাসে কারিগরি শিক্ষা দিতে হবে শিক্ষার্থীদের। সাথে করে প্রতিটা স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে প্রযুক্তি নির্ভর সংগঠন থাকতে হবে।
0 coment rios: